লেখক-মুহাম্মদ বোরহান উদ্দিন.রাউজান।
পরিচ্ছন্ন উপজেলা গড়ে তুলতে
সাপ্তাহের একদিন ওরা ‘পরিচ্ছন্নকর্মী’
মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস। কারও হাতে ঝাড়ু, কারও হাতে ঝুড়ি, আবার কারো হাতে
পলিথিন, কারো হাতে বেলসা। সড়কের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা সাফ করছেন
তাড়াতাড়ি। দূর থেকে মনে হবে তাদের পরিচ্ছন্নকর্মী। তবে তারা পেশাদার পরিচ্ছন্নকর্মী নয়। সড়ক কিংবা দোকানের আশ পাশে কোণায় জমে থাকা ময়লা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন
কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থী। বাকি কয়েকজন শিক্ষার্থী সেই ময়লা ঝুড়িতে ভরে নির্দিষ্ট স্থানে
স্তুপ করছেন। এভাবে বাজারে অলিতে গলিতে নর্দমা থেকে ময়লা হাতে নিয়ে ঝুড়িতে কিংবা
পলিথিনে স্তুপ করছেন তারা। এ দৃশ্য দেখে বাজারে থাকা পথচারী, ব্যবসায়ীরা সবাই অবাক! ঘটনা কি? সবাই কৌতুহল জানার জন্যে। তবে জানতে সময় লাগেনি বেশিক্ষন। অল্পক্ষনে সবাই জানতে পারল একদল স্বপ্নবাজ তরুণের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কথা। উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের এসব তরুণ শিক্ষার্থী ‘বিডি-ক্লিন রাউজান’ নামে একটি সেচ্চাসেবী
সংগঠনের সদস্য। তারা বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। অ্যাকাডেমিক পড়ালেখার
পাশাপাশি একদিন তারা ‘পরিচ্ছন্নকর্মী’। এ সংগঠনের উদ্যোগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার
সকালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের আমিরহাট বাজারে পরিস্কার
পরিচ্ছন্নতার অভিযানে আসে এ তরুণরা। এসময় মাত্র ৩-৪ ঘন্টার ব্যবধানে যত্রতত্র ফেলা সব ময়লা
আবর্জনা পরিস্কার করে পুরো আমিরহাট বাজারের অলি-গলি চকচকে পরিস্কার পরিচ্ছন্নরুপে পরিবর্তন করে দেয় তরুণ শিক্ষার্থীরা। এ পরিবর্তন ও তাদের কার্যক্রম দেখে বাজারে আসা পথচারী ও দোকানীরা বেশ খুশি। তাদের এ মহতি কর্মকান্ড দেখে ছুটে এসেছেন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম। তিনি তরুণদের ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের প্রসংশা করে তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।
এ বিষয়ে আমিরহাট বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি এস এম বাবর বলেন, তরুণদের
এই কার্যক্রম দেখে সত্যিই আমি অভিভুত। সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন সেবামূলক
সংগঠনের এভাবে পরিচ্ছন্নতার কাজ চালালে একদিন পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ ঘোষণা করাও সম্ভব
হবে বলে মনে করেন তিনি।
সেচ্চাসেবী তরুণদের সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রতি সপ্তাহেই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের
বিভিন্ন স্থান পরিচ্ছন্ন করে যাচ্ছে একদল স্বপ্নবাজ তরুণেরা। তারই ধারাবাহিকতায়
পরিচ্ছন্ন কর্মসুচি পালন করেন রাউজান উপজেলা বিডি ক্লিনের সদস্যরা। পরিস্কার অভিযানে
আমিরহাট বাজার ছিল তাদের রাউজানে প্রথম কর্মসুচী। এতে অংশগ্রহন করে তাদের ১৫ জন
সেচ্চাসেবী তরুণ শিক্ষার্থী। তাদের দ্বিতীয় কর্মসূচী পালিত হয় ১১ অক্টোবর শুক্রবার বিকালে
রাউজান উপজেলার রমজান আলীহাটে। তৃতীয় কর্মসুচী পালিত হয় গত ২৫ অক্টোবর শুক্রবার
বিকালে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী বাজারে। এতে বিডি ক্লিন রাউজান উপজেলার ১৭ জন সেচ্চাসেবী তরুণের একটি টিম অংশগ্রহন করেন। তাদের প্রতিটি ইভেন্টেই পাঠ করা হয়
শপথ বাক্য।
এর আগে ২০২১ সালের মধ্যে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার প্রত্যয়ে সারা দেশের মতো
বিডি ক্লিন রাউজানের যাত্রা শুরু হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শুক্রবার। সেদিন রাউজান
সুর্যসেন চত্বরে এক পরিচিতি সভার মাধ্যেমে এ যাত্রা শুরু করে তারা। প্রায় অর্ধশত তরুণ-
তরুণী পরিচ্ছন্ন রাউজান উপজেলা গড়ার একটি সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিডি ক্লিন
রাউজানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। পরিচ্ছন্ন উপজেলা হিসেবে বাংলাদেশের বুকে রাউজানকে তুলে
ধরতে এখন পর্যন্ত ৩টি ইভেন্ট পরিচালনা করেছে তারা। প্রতি শুক্রবার ও সরকারী ছুটির দিনে তারা
উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামেন। পরিষ্কার করেন স্থানটি
পরিচন্ন না হওয়া পর্যন্ত। তাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখা।
তরুণরা আরো বলেন, আপনার আমার এবং আমাদের সকলের সচেতন মনোভাবই পারে একটি
পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ে তোলার গতিকে ক্রমশ ত্বরান্বিত করতে। তাই আসুন সকলে মিলে যোগ
দেই এই পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে, আসুন আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি একটি ময়লাও
আর যত্রতত্র নয়।
এ কার্যক্রম সম্পর্কে বিডি-ক্লিন চট্টগ্রাম উত্তর ও রাউজান উপজেলার সমন্বয়ক সাইমুর
রহমান ফরহাদ বলেন, কার্যক্রম নিয়ে বিডি ক্লিনের কোন মতামত নেই, আছে শুধু লক্ষ্য। বিডি
ক্লিনের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তিতে বাংলাদেশকে একটি পরিচ্ছন্ন দেশ হিসাবে উপহার দেওয়া, তাই বিডি ক্লিনের প্রত্যেক তরুণ তরুণী
সপ্তাহের শুক্রবার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ময়লা কুড়িয়ে মানুষকে দেখিয়ে সচেতন করে দিচ্ছে
যেখানে সেখানে যততত্র ময়লা আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য। তাই আসুন আজ
থেকে আমরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার বদ অভ্যাস পরিহার করি এবং বাংলাদেশকে একটি
পরিচ্ছন্ন দেশ হিসাবে গড়ে তুলি।
বিডি ক্লিন রাউজানের সদস্যদের পরিচন্ন অভিযান দেখে তরুণ ব্যবসায়ী কপিল উদ্দিন বলেন,
জানি না এরা কারা হয়ত আমার মত কোন মায়ের সন্তান। আমাদের হলদিয়া আমির হাট বাজারে
তাদের আজ ময়লা খুঁড়াতে দেখে খুব অবাক হলাম। কিছুটা লজ্জাও পেলাম আমাদের ময়লাগুলো তারা পরিস্কার করছে। যেগুলো আমাদের পরিস্কার করা উচিৎ ছিল। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমরা সচেতন না হলেই বদলাবে না কিছুই।ঔষধ ফার্মেসী ব্যবসায়ী সুজন সেন বলেন, এ দেশের প্রত্যেক মানুষকে রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে সুস্থভাবে বাঁচাতে আসুন পরিচ্ছন্ন মানসিকতা গড়ে তুলি, পরিহার করি যত্রতত্র ময়লা ফেলার নোংরা অভ্যাস, গড়ে তুলি পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত সোনার বাংলাদেশ।
ব্যবসায়ী এ আর স্বপন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান জীবন বদলে যাবে। আশ্চর্য হলেও সত্য আমির হাট বাজারে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে এমন ১৫ জন শিক্ষার্থী বাজারের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সম্পুর্ণ পরিস্কার করে ফেলেছে! তাদের উক্তি, ‘সঠিক জায়গায় ময়লা ফেলবো, দূষন মুক্ত
দেশ গড়ব’ চলুন আমরাও তাদের অনুস্বরন করি।
এছাড়াও প্রবাসী সাজ্জাদ হোসেন নামের একজন বলেন, তরুণদের এ মহৎ উদ্যোগ ও শ্রম তখনই
স্বার্থক হবে যদি আমাদের বিবেকবোধ কিছুটা হলেও জাগ্রত হয়, আরেকজন লিখেন নিজ
নিজ স্থান থেকে যদি আমরা সবাই এভাবে সচেতন হই তাহলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে,
আমাদের সচেতনতাই পারে সুন্দর একটি দেশ গড়তে। অন্য আরেকজন বলেন এ ধরনের উদ্যোগ মুলত দেশত্ববোধের পরিচয়, দেশ জাতির কল্যাণে কাজ করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
তরুণদের এ পরিচ্চন্নতা কার্যক্রমটি ‘একটি মহতি উদ্যোগ’ বলে উল্ল্যেখ করেন আমিরহাট
বাজারের মো.ইলিয়াছ, মো.হাসেম, জয়নাল, জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু, মহিউদ্দিন, সুমন, শফি
সওদাগর, ডা. দুলন, সাগর, লিটন, জামাল, মামুন, ইসমাইল, আমিনুল ইসলাম, বাবু, সাজেদ,
শাহাদাৎ, সোহেল, মোরশেদ হোসেন চৌধুরীসহ বাজারের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দরা।
সবার সাথে আমিও বলতে চাই ‘শুধু সচেতনতার অভাবে আমরা ময়লা ফেলি যত্রতত্র। আমি একজন সচেতন নাগরিক, আমি যত্রতত্র ময়লা ফেলে এ শহর তথা দেশকে নোংরা করতে চাইনা। কিন্তু বাস্তবতায় পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের অভাবে আমরা হয়তো কখনো কখনো বাধ্য হই রাস্তাঘাটে ময়লা আবর্জনা ছুড়ে ফেলতে। প্রয়োজন অনুযায়ী ডাস্টবিন স্থাপন কিংবা নির্দিষ্ট স্থান ও তা
থেকে প্রতিদিন ময়লা সরিয়ে পরবর্তীতে ব্যবহারের উপযোগী করে দিলে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের
নোংরা অভ্যাস পরিহার করে এ শহর তথা দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সক্ষম হব। আমিও চাই আমার
পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠুক পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে।
পরিশেষে বলতে চাই তারুণ্য শুধু স্বপ্ন দেখতেই জানে না, জানে স্বপ্ন পুরণের পথ প্রশস্ত করতে,
আর জানে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেও। ছিনিয়ে আনতে পারে যে কোনো জয়, অদম্য শক্তি ও
মনোবল দিয়ে। যেভাবে ছিনিয়ে এনেছিল এই স্বাধীন বাংলা। তারুণ্যের বুকে জাগ্রত এখন
এক নতুন স্বপ্ন। বাংলার বুকে থাকবেনা আর একটিও ময়লা। আর সেই স্বপ্ন পুরণের লক্ষ্যে
এগিয়ে যাচ্ছে এই নির্ভীক তারুণ্য বিডি ক্লিন রুপে। পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোমী এ তরুণরা এগিয়ে যাক অনেক দুর, বদলে দিক এ গ্রাম শহর তথা পুরো দেশকে। বদলে দিক আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে। এটি পত্যাশা করি।
প্রসঙ্গত, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন উপজেলা গড়তে ‘বিডি ক্লিন রাউজান’ এর মোহাম্মদ জামশেদুল
আলম, মোহাম্মদ জমিদুল হক, জামশেদ মাহমুদ সহ কাজ করছেন একঝাঁক তরুণেরা।
(রাউজান নিউজ.আমির হামজা.বার্তা বিভাগ.আপনার সংবাদ জানাতে –০১৫৫৯-৬৩৩০৮০)
Add comment